আগস্ট, ১৯৭১; বাংলার মাটিতে যুদ্ধ চলছে পুরোদমে! স্থলভাগে মুক্তিফৌজের হাতে নাজেহাল হানাদারদের ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে আকাশপথে রসদের যোগান। একমাত্র ভরসা জলপথ! বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে এলো ১৬ই আগস্টের দিবাগত রাত, গর্জে উঠতে লাগলো বিস্ফোরণের হুঙ্কার! সলিলসমাধি হলো নৌযান ও হাজার হাজার টন বারুদ-অস্ত্রাদির।
জেনে গেল পুরো বিশ্ব, পূর্ব পাকিস্তানে আদতে সব ঠিক নেই। হানাদারদের মনোবলে চিড় ধরিয়ে দিলেন বুকে মাইনবেঁধে আত্মঘাতী মিশনে অংশ নেয়া বাংলার কিছু নৌ-কমান্ডো! সাহসিকতা ও বীরত্বে রচনা হলো মুক্তিযুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়ের- অপারেশন জ্যাকপট ১৯৭১!
মধ্য আগস্টে বাস্তবায়ন হওয়া এই মিশনের শুরুর গল্পটা আরেকটু পেছনের। ২৫শে মার্চের গণহত্যার ভয়াবহতা জেনে দেশের টানে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসেন পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংগ্রো তে কর্মরত ৮জন বাঙালি অফিসার।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসা এই অসমসাহসীদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল: “২৬ শে মার্চ আমরা নতুনরূপে জন্ম নিয়েছি। আমরা আমাদের দেশের জন্য লড়তে যাচ্ছি।”
কালক্রমে গঠিত ১০ নং সেক্টর (নৌ) এর অধীনে সেসব কমান্ডো ও অন্যান্যদের নিয়ে শুরু হয় অপারেশন জ্যাকপটের প্রস্তুতি। দিনপ্রতি ১৮ ঘণ্টা করে টানা তিনমাস কঠিন প্রশিক্ষণ চলতে থাকে গোপনীয়ভাবে।

প্রশিক্ষণ ছিলো দুটি স্তরের- স্থল ও জলযুদ্ধ! বিস্ফোরকের ব্যবহার, গ্রেনেড-অস্ত্র চালানো, অস্ত্র ব্যতিরেকে লড়াইয়ের কৌশল ছিল স্থলযুদ্ধ প্রশিক্ষণের অংশ। জলযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ছিল আরও প্রখর!
আর তা রপ্ত করতে হতো তীব্র খরস্রোতা ভাগিরথী নদীর জলে। প্রচণ্ড স্রোতে নানা রকম সাঁতার, বুকে ভার বেঁধে, শুধু নাক ভাসিয়ে সন্তরণসহ নৌযানের কেবল ভেঙে বিশেষভাবে নৌযান ডোবানোর প্রশিক্ষণ ছিল জলযুদ্ধের প্রস্তুতির অংশ। টানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে অবস্থানে সক্ষমতা অর্জন করেন তারা! প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয় আগস্টের প্রথম সপ্তাহে!
পঁচিশে মার্চের গণহত্যার রেশ হানাদাররা টেনে চলেছিল একাত্তরের আগস্ট মাসেও। নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতনের কদর্য অধ্যায় নির্মাণে তাদের সঙ্গ দিয়েছিল এদেশেরই কিছু ঘৃণ্য মানুষ! পাকিস্তানি সেনাদের নির্মমতার চিত্র বীভৎসতারই নামান্তর। নিধনকার্যে গোলাবারুদের ব্যবহারে শীঘ্রই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তারা। মনোরঞ্জনার্থে বেছে নেয় নানা ভয়াবহতার পথ।

মানুষকে চিড়ে দু’ভাগ করা, খেজুর গাছের ওপর হত্যা, দড়িবেঁধে টেনে-হিঁচড়ে নেয়া, হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলা, চামড়া ছাড়িয়ে নেয়া, গাছে ঝুলিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মতো মানবতাবিরোধী নৃশংসতার গল্প তৈরি হতে থাকে প্রতিনিয়ত। নদীর স্রোত যেন হয়ে ওঠে লাশের ফেরিওয়ালা!
হানাদারদের নির্যাতন-নিধনযজ্ঞ, মুক্তিবাহিনীর অগ্রসরতার অন্তরালে সঙ্গোপনে কুঁড়ি মেলছিল অপারেশন জ্যাকপট। এটি ঠিক কবে কার্যকর হবে জানতেন না স্বয়ং জেনারেল ওসমানীও! এমনকি জানতেন না যে এলাকায় সংঘটিত হবে সেখানে নিয়োজিত সেক্টর কমাণ্ডার ব্যতীত অন্য কেউ। কেউ শত্রুবন্দী হলেও যেন এই অপারেশনের কথা ফাঁস না হয় তাই এই গোপনীয়তা। কঠিন চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত নৌ-কমাণ্ডোরা জানতেন এটি হতে যাচ্ছে এক আত্মঘাতী তথা সুইসাইডাল মিশন।
“আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু হলে কেউ দায়ী থাকবে না”– এই মর্মে স্বাক্ষর করেন তাদের প্রত্যেকেই।
অতঃপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ত্রিপুরা থেকে নির্দেশ পেয়ে বেরিয়ে পড়েন দুধর্ষ যোদ্ধাদল। ৩-৯ আগস্টের মধ্যে রওয়ানা হয়ে ১২ তারিখের মধ্যে পৌঁছে যান নির্ধারিত সেফ হাউজে। এবার শুধুই অপেক্ষা, আক্রমণীয় সংকেতের।
গোপনীয়তার স্বার্থে নির্দেশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল দুটি গান-যা জানা ছিল শুধু অপারেশন কমান্ডারদের! ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যতো গান‘ গানটিই প্রথম সংকেত! অর্থাৎ সময় সন্নিকটে বা ৪৮ ঘণ্টার ভেতর আক্রমণ করতে হবে। দ্বিতীয় সংকেতের গানটি – ‘আমার পুতুল যাবে শ্বশুরবাড়ি’ যার অর্থ হামলার্থে ঘাঁটি ত্যাগ করতে হবে।
কমান্ডোদের প্রত্যেককে দেয়া হয় সাঁতারের পোশাক, একটি করে লিমপেট মাইন ও ছুরি, একজোড়া সাঁতারের ফিন ও শুকনো খাবার। এছাড়াও কিছু কম্পাস, প্রতি তিনজনে একজনকে স্টেনগান ও গ্রেনেড দেয়া হয়। দলনেতাদের দেয়া ছিল ট্রানজিস্টর রেডিও। ১৩ ও ১৪ তারিখ আকাশবাণীতে প্রচারিত হয় সংকেতের গান দুটি! সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়েন নৌ-গেরিলারা! চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মংলা অভিমুখে নিযুক্ত ছিলো যথাক্রমে ৬০ জন, ২০ জন, ২০ জন ও ২৬০ জনের দল। তাদের সাহায্যার্থে যথাক্রমে সেক্টর-১, সেক্টর-২ ও সেক্টর-৯ এর যোদ্ধারা।

১৬ই আগস্ট রাত্রির প্রথম প্রহর! সন্তর্পণে মাইন জাহাজে লাগিয়ে সরে আসেন যোদ্ধারা! প্রকাণ্ড বিস্ফোরণে চমকে ওঠে চট্টগ্রাম নৌ-বন্দর! প্রথম বিস্ফোরণ ১টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়, এরপর একে একে চলতে থাকে ধ্বংসলীলা। তলিয়ে গেল এমভি হরমুজ, এমভি আল আব্বাস ও ওরিয়েন্ট বার্জ নং ৬ নামক তিনটি জাহাজ! সঙ্গী হলো আরও ৭টি নৌযান। প্রায় ২৬,০০০ টন গোলাবারুদ ততক্ষণে বিনষ্ট হয়েছে পানিতে ডুবে। শেষপর্যন্ত চট্টগ্রাম অপারেশনে অংশ নিয়েছিল ৩১ জন নৌ-গেরিলা। পরদিন পাকিস্তান বিবৃতি দেয়- ‘চিটাগাং পোর্ট ইজ নন-অপারেশনাল। চিটাগাং পোর্ট ড্যামেজড বাই টেরোরিস্টস’!

সাবমেরিনার বদিউল আলম নেতৃত্ব দেন চাঁদপুর অপারেশনে। তিনটি দলে ভাগ হয়ে এতে অংশ নেয় মোট ১৮ জন। মোট ৪টি জাহাজে তারা মাইন লাগিয়ে দেন এবং ৩টি স্টীমার-জাহাজসহ আরো কিছু নৌযান ডুবে যায়। নারায়ণগঞ্জে একই সময়ে সংঘটিত হয় আক্রমণ। সাবমেরিনার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে এতে অংশ নেন ২০ জন। ডুবিয়ে দেন ৪টি নৌযান। এছাড়া দাউদকান্দিতেও চালানো হয় অপারেশন।
সেজান মাহমুদ এর অপারেশন জ্যাকপট (হার্ডকভার) বইটি পড়তে পারেন
মংলা অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বে থাকা ২৬০ জনের দলটি। এদের ৬০ জন নৌ- ও বাকিরা ছিলেন সি অ্যান্ড সি কমান্ডো। মংলা অপারেশনে বাধে বিপত্তি। রাত দুটোর মধ্যে মাইন লাগানোর কথা ছিল। সেখানে পথনির্দেশকের ভুলের কারণে যোদ্ধারা নির্ধারিত এলাকায় পৌঁছান ভোর চারটায়। অন্যান্য সকল লক্ষ্যে ততক্ষণে অপারেশন চালানো শেষ!
অগত্যা ৪টা ৩০ মিনিটে শুরু হওয়া অপারেশনে, বন্দরে থাকা ১৪টি জাহাজের ৬টিতে মাইন লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ কাজে অংশ নেন ২৪ জন নৌ-কমান্ডো। সি অ্যান্ড সি কমাণ্ডোগণ ৬৬ জনের তিনটি উপদলে বিভক্ত হয়ে তাদের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পশুর নদীর হাঁটুপানিতে নেমে আসেন সাবকমান্ডার রাজা ও খিজির। বিস্ফোরণ শুরু হয় ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে। ধ্বংস হয় সোমালীয়, মার্কিন, জাপানী, পাকিস্তানি ও দুটি চীনা জাহাজ। ডুবে যায় ৭,০০০ টন অস্ত্রবাহী এসএস লাইটনিং। এই অপারেশনে মোট ৩০,০০০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিনষ্ট হয়। নিখোঁজ হন দুজন মুক্তিযোদ্ধা।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে খবর, বিশ্বাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ পায় অন্যরকম পরিচিতি। ভেস্তে যায় ‘পূর্ব পাকিস্তানে সব নিয়ন্ত্রণে আছে’ সূচক লোক দেখানো নাটক। অন্যান্য দেশগুলো জেনে যায় তাদের জাহাজ আর পূর্ব পাকিস্তানে নিরাপদ নয়! এই অপারেশনের পর কোনো দেশই তাদের জাহাজ পাঠাতে সম্মত হয়নি। অকার্যকর ঘোষণা করা হয় বন্দর ও চ্যানেলগুলোকে।
অপারেশন জ্যাকপট জাগিয়েছিল বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধকে এনে দেয় গর্বময় পরিচিতি। যুদ্ধশেষে নানান খেতাবে ভূষিত হন এতে অংশ নেয়া বীরগণ। এভাবেই রক্তের অক্ষরে লেখা হয়েছে আমাদের ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা বিষয়ক সকল বই পড়তে ক্লিক করুন
তথ্যসূত্র:
১) অপারেশন জ্যাকপট
২) অপারেশন জ্যাকপট ১৯৭১: দুঃসাহসী এক আত্মঘাতী মিশন
৩) Operation Jackpot retold: ‘It was like a suicide mission’
৪) ‘অপারেশন জ্যাকপট’
৫) ১৯৭১ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা/ সম্পাদনা: রশীদ হায়দার
৬) ঘুম নেই/ নাসির উদ্দিন ইউসুফ
লিখেছেনঃ অনন্যা আজাদ
comments (0)